Skip to content

আমাদের গল্প

বই পড়ার প্রতি কোনো আগ্রহই আমার ছিল না। কারণ পাঠ্যবই পড়ার বাধ্যবাধ্যকতা "বই" নামক জিনিসটিকে বিষিয়ে তুলেছিল আমার কাছে। কিন্তু আমার মা আমাকে বই পড়তে বলতেন। মামাতো ভাই রনি ভাই তখন গল্পের বই পড়তেন। সেগুলো মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে দেখতাম। কিন্তু উনি যখন কমিক্‌স বই পড়তেন, বিশেষ করে ভারতীয় বাংলার "চাচা চৌধুরী", "বিল্লু", "পিঙ্কী" কিংবা "ফ্যান্টম" - এগুলো তখন দারুণ লাগতো। খালাতো ভাই সেলিম ভাইয়ের বাসায় গেলে বুঁদ হয়ে পড়তাম বাংলায় "টিনটিন" কমিক্স সিরিয। "বই" পড়ার আগ্রহটা সেভাবেই একটু একটু করে দানা বাঁধতে থাকে। তারপর সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন বন্ধু সজীব "তিন গোয়েন্দা"র সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বিপত্তির সূত্রপাত করলো - আর সেই থেকে পাক্কা বইখোর হয়ে গেলাম। আর তারই সাথে শুরু হলো বই সংগ্রহের নেশা।

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে, গ্রন্থাগারের নাম দেয়া হলো: "জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার"

মামাতো ভাই আর আমি মিলে একত্রে একটা শেল্‌ফের মধ্যে বই জমাতে শুরু করলাম। দুই ভাই মিলে কৈশরসুলভ বাতুলতায় লাইব্রেরীর নাম দিলাম "দি ন্যাশনাল ফাইটার লাইব্রেরী" 😆। দাঁড়ান, আগে একটু হেসে নিই... 😂🤣। কিন্তু সেটা বেশিদিন টিকলো না। বাচ্চাদের মধ্যে সহজেই ঝগড়া লেগে যায়। ঝগড়া লেগে আলাদা হয়ে গেলাম। নিজের বইগুলো নিয়ে এলাম নিজের ঘরে। টেবিলের উপরে কিংবা আম্মার শো-কেসের উপরেই জায়গা হলো সেগুলো। আর তখনই, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে, গ্রন্থাগারের নাম দেয়া হলো: "জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার"

সেই ছিল শুরু। আম্মার বই, আমার বোনের বই - আর আমার কেনা বিভিন্ন বই, যেমন: মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিংবা তিন গোয়েন্দার বিভিন্ন বই - এগুলোই তখন প্রথম দিককার সংগ্রহ। একটা সময় আরো আরো বই সংগ্রহের নেশা চাপে। তখন বিভিন্নজনকে তাদের অবহেলিত বইগুলো আমার গ্রন্থাগারে দান করে দেবার প্রস্তাব দেই। এবং এভাবে বেশ কিছু বইও সংগ্রহ হয়ে যায়। তারপর থেকে কিনেছি, অনুদান পেয়েছি, উপহার পেয়েছি - সব মিলিয়ে রীতিমতো সংগ্রহটা বাড়তে থাকে। বইয়ের শেল্‌ফে জায়গার দখল বাড়তে থাকে। টেবিলের উপরেও জায়গা হয় কিছু বইয়ের। সাথে বাড়তে থাকে পেপারকাটিং আর রহস্যপত্রিকা কিংবা এরকম বিভিন্ন কিশোর পত্রিকার সংগ্রহও।

আমার গ্রামের বাড়িতে বেশ কিছু বই ছিল। বাড়িতে গিয়ে সেখানে হানা দিলাম। ধুলো পড়া জীর্ণশির্ণ অবস্থা থেকে একটা একটা করে বই সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। খুব কষ্ট পেলাম যখন দেখলাম, অপূর্ব একটা ইলাস্ট্রেটেড মেডিক্যাল ডিকশোনারির ভিতরে সাদা সাদা পোকারা রীতিমতো বিশাল বড়সড় একটা গর্ত করে সুখের কলোনী স্থাপন করেছে - ঐ বইটা হারালাম। তবে সেখান থেকে একটা দারুণ সংগ্রহও হলো: গ্রাম্য পুঁথির বই। এটা একটা দারুণ আবিষ্কার ছিল।

ঢাকায় তখন থাকতাম রামপুরার কুঞ্জবনে। সেখানে একটা কোচিং সেন্টারে বিশাল শেল্‌ফে এলাকার যুবকরা নিজেদের বইগুলো একত্র করে তৈরি করে "কুঞ্জবন পাঠাগার"। সময়ের আবর্তে দেখলাম, সেটা হারিয়ে গেছে। খোঁজ লাগালাম। জানলাম, ভেঙে যাবার পর, যার যার বই সে সে নিয়ে গেছে, তবে একজনের কাছে এখনও কিছু বই রয়ে গেছে। সেখান থেকে ঐ বইগুলো অনুদান হিসেবে জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগারে নিয়ে এসে জিইয়ে নিলাম।

আমার এক বন্ধু আছে, সে স্কুলে থাকতে তার বইয়ের একটা পাতাও আস্ত থাকতো না। মোটামুটি প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পরে তার বইয়ের প্রথম দিককার অর্ধেক পাতা উধাও হয়ে যেত। এরকম দুর্জন বন্ধুর বাসায় যেদিন দেখলাম অপূর্ব একটা বিশাল "সেরা সন্দেশ" সংকলন ছিঁড়তে বসেছে, তাকে অনুরোধ করে বইটা সংগ্রহ করে নিয়ে এলাম গ্রন্থাগারে। সেটাকে পরিপাটি করে বাইন্ডিং আর মেরামত করে স্থান দিলাম গ্রন্থাগারে।

আমি ক্লাস সেভেনের এক ছাত্রকে পড়াতাম - রাশিক তার নাম। তার পরিবার খুবই পড়ুয়া, মা সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাতে পড়ালেখা করেছেন। ঐ ছোট্ট রাশিক আমার গ্রন্থাগারের কথা শুনে ওর মায়ের সাথে পরামর্শ করে ওর সংগ্রহে থাকা সেবা প্রকাশনীর অনেক অনেকগুলো "রহস্যপত্রিকা" অনুদান দিয়ে দিলো। রাশিকরা এখন কোথায় থাকে জানি না, ওর খুব শখ ছিল ক্যাডেট কলেজে পড়বে।

বইমেলায় গেছি আমি আর আমার বন্ধু। একটা বই দেখে আগ্রহ হলো। ওটা হাতে নিয়ে দাম দেখছি, নাম: "ইশারা ভাষায় যোগাযোগ"। কথাপ্রসঙ্গে বন্ধু, দোকানে থাকা ব্যক্তিকে বললো, ওর একটা লাইব্রেরী আছে। শুনে দোকানী আমাকে বইটা বিনামূল্যে দিয়ে দিলেন। এবং আরো বই বিনামূল্যে সংগ্রহ করবার জন্য একটা কার্ড দিয়ে যোগাযোগের কথাও জানিয়ে দিলেন।

এভাবেই বিন্দু বিন্দু ভালোবাসায় জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার এগিয়ে গেছে সময়ের পর সময়ে। সময়ে সময়ে আমরা শিখেছি কিভাবে বইয়ের যত্ন নিতে হয়, আমরা সমাজকেও সেটা জানিয়েছি। এইচএসসি পড়বার সময় Microsoft Access শিখে সাথে সাথে গ্রন্থাগারের একটা ডাটাবেজ বানিয়েছিলাম। সেটা অনেক কাজের কাজ হয়েছিল। আমার শেখাও হয়েছিল, আর তখন স্বল্পপরিসরে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ঘাঁটাঘাটিরও কিছুটা সুযোগ হয়েছিল বলা যায়। গ্রন্থাগার গোছাতে নটর ডেম কলেজের "ফাদার নোভাক লাইব্রেরী"ও যথেষ্ট ইন্ধন দিয়েছিল বলা চলে।

আমরা কখনোই আর্থিক অনুদান নিইনি। কারণ তখন অনেক আত্মীয়াই কান কথা ছড়াতেন, "বই দিয়ে ইনকাম বের করছে"। এজাতীয় কথা কিংবা কুৎসা যেন কেউ না ছড়াতে পারে, সেজন্য আর্থিক অনুদান নেয়া থেকে গ্রন্থাগার বিরত থাকলো। বই এবং গ্রন্থাগারের অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করতে পারতেন পরিচিত লোকজন - সম্পূর্ণ বিনামূল্যে

বই নেয়ার জন্য একটা খাতায় নাম-ধাম লিখে স্বাক্ষর করে দিতে হতো। গ্রন্থাগারের জন্য নিয়ম-কানুনও তৈরি হয়েছে। কিন্তু এতকিছুসত্ত্বেয় কয়েকজন খামখেয়ালী পাঠক আমাদের বই হারিয়ে ফেললেন। শুধু হারিয়েই ফেললেন না, সেগুলো শোধ করারও বিন্দুমাত্র তাগাদা তারা অনুভব করলেন না। এটা আমার জন্য খুবই কষ্টের কারণ ছিল। কিচ্ছু করার ছিল না। এর মধ্যে দুয়েকজনের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে বইটা হয়তো কিনেছি, প্রথম বইটা (হয়তো কারো অনুদানের ছিল, কিংবা লেখকের স্বাক্ষরিত ছিল) - সব স্মৃতি নিয়ে পালিয়ে গেলে সেই উপলব্ধি কি আর পরের বইয়ে থাকে?

সময়ের সাথে মানুষের বই পড়ার চাহিদা কমে গেছে। অনেক আগে থেকেই লাইব্রেরীর একটা অনলাইন ডাটাবেয বানানোর ইচ্ছা ছিল, একটা বানিয়েওছিলাম একটা সময়ে (জানুয়ারি ২০১৩) - কিন্তু সেটা আমাকে PHP-MySQL কোড করতে শেখালেও গ্রন্থাগারের জন্য তেমন কোনো উপকার বয়ে আনতে পারেনি। অনেকেই মাঝে মাঝে এখনও বই পড়ার আগ্রহ জানান যখন জানেন আমার বাসায় একটা গ্রন্থাগার আছে। কিন্তু মাইক্রোসফ্‌ট অ্যাক্সেসে করা ডাটাবেযটা দিতে পারি না - ওটা অনেকে খুলতেই পারবেন না। সেই তাগাদা থেকেই আবার গ্রন্থাগারের জন্য একটা ডাটাবেয বানানোর উদ্যোগটা নেয়া।

অনলাইন একটা বিনামূল্য টুল আমাকে অ্যাক্সেস ডাটাবেযটা MySQL-এ কনভার্ট করতে সহায়তা করায় কাজটা কিছুটা এগিয়ে গেলো। গুরুজনদের থেকে শেখা লারাভেল পিএইচপি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে তাই দ্রুততার সাথে ওয়েবসাইটটা দাঁড় করাতে চেষ্টা করলাম - উদ্দেশ্য কোনোরকমে পাঠকরা যেন বইগুলো অন্তত অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন কিংবা অন্তত দরকারের সময় আমার সংগ্রহে অমুক বইটা আছে - এটা অন্তত জানতে পারেন। এই ওয়েবসাইট তৈরির যাবতীয় সহায়তা আলাদা একটি পাতায় চিত্রণ করা হয়েছে।

এই গ্রন্থাগার আমি, আমার বাবা-মা-বোন - এঁদের সংগৃহীত বইয়ে শুরু হলেও দিন শেষে এখন জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার পারিবারিক পাঠাগারের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন গণমানুষের পাঠাগার হয়ে গেছে। কিন্তু তবু আমাদের কোনো পাঠকক্ষ নেই, বই রাখার জায়গার সংকুলান হয় না, সময়ের অভাবে আগের মতো বইয়ের যত্নআত্তিও করা হয় কম - তবু আমরা জ্ঞানের পথযাত্রী হয়ে থাকতে চাই আজীবন।

জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার আপনাদের দোয়াপ্রার্থী।

---

মঈনুল ইসলাম
প্রধান সত্ত্বাধিকারী
জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার, ঢাকা

৮ নভেম্বর ২০১৯; ১৬:৪২